রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০৩:২৯ পূর্বাহ্ন

জামশেদপুরে হিন্দু-মুসলিম সঙ্ঘর্ষের পর নামল দাঙ্গা পুলিশ

জামশেদপুরে হিন্দু-মুসলিম সঙ্ঘর্ষের পর নামল দাঙ্গা পুলিশ

স্বদেশ ডেস্ক:

হিন্দুদের রামনবমী উৎসবের পতাকা ছেঁড়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলিম সঙ্ঘর্ষের জেরে পূর্ব ভারতের শিল্পশহর জামশেদপুরে দাঙ্গা পুলিশ নামানো হয়েছে।

ঝাড়খন্ড রাজ্যের ওই শহরে জারি করা হয়েছে ১৪৪ ধারা, সাময়িকভাবে বন্ধ আছে মোবাইল ইন্টারনেট পরিষেবাও।

এদিকে পাশের রাজ্য বিহারে পুলিশ সাংবাদিক বৈঠক করে ঘোষণা করেছে, রামনবমীর সময় সেখানে যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তা রীতিমতো সোশ্যাল মিডিয়া ও হোয়াটসঅ্যাপে পরিকল্পনা এঁটে করা হয়েছিল।

উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বজরং দলের নালন্দা জেলার প্রধানকে তারা এই ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

বস্তুত রামনবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যে দাঙ্গা ও সঙ্ঘর্ষ শুরু হয়েছিল, ওই উৎসবের ১২ দিন পরও তা এখনো থিতোয়নি।

পূর্ব ভারতের তিনটি রাজ্য– পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও ঝাড়খন্ডেই সবচেয়ে বেশি উত্তেজনা ও সহিংসতার আঁচ পড়েছে। ঘটনাচক্রে এই তিনটি রাজ্যেই এখন বিজেপিবিরোধী সরকার ক্ষমতায় আছে।

তবে মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের মতো যে সব রাজ্যে বিজেপি এককভাবে বা শরিকদের নিয়ে ক্ষমতায় আছে, সেখানেও নানা জায়গাতে রামনবমীর সময় সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘর্ষ হয়েছে।

পর্যবেক্ষকরা অনেকেই বলছেন, অতীতে রামনবমীর অনুষ্ঠান মূলত বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ইদানীং রাজপথে শোভাযাত্রা করে রামনবমী পালনের ধূম পড়েছে, বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো নানা রাজ্যে যার আয়োজন করছে।

বিশেষ করে যেখানে বিজেপি ক্ষমতায় নেই, সেখানে বিজেপি ও তাদের সমর্থক সংগঠনগুলো পায়ের তলায় শক্ত জমি পেতে সুকৌশলে রামনবমীকে ব্যবহার করছে বলেও তারা ধারণা করছেন।

জামশেদপুরে যা ঘটেছে
রামনবমীর সময় শহরের শাস্ত্রীনগর এলাকায় টাঙানো হিন্দুদের একটি পতাকা কেউ বা কারা ছিঁড়ে ফেলে ধর্মীয় অবমাননা করেছে, এই অভিযোগকে কেন্দ্র করে জামশেদপুরে থমথমে উত্তেজনা ছিল শনিবার (৮ এপ্রিল) থেকেই।

এই ঘটনায় দোষীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে, এই দাবিতে হিন্দুরা গতকাল আবার মিছিল বের করে এবং একটি থানাও ঘেরাও করা হয়।

রোববার সন্ধ্যায় এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে সঙ্ঘর্ষ বাঁধে, দু’পক্ষই পরস্পরের বিরুদ্ধে পাথর ছোঁড়ে এবং অনেকে আহত হয়।

ক্ষুব্ধ জনতা দু’টি দোকানও জ্বালিয়ে দেয়, একটি অটোরিক্সাতেও আগুন ধরানো হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে।

এরপর আজ সোমবার ভোররাতেই শহরে দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করা হয় এবং কারফিউ জারি করা হয়।

জামশেদপুরের পুলিশ প্রধান প্রভাত কুমার অবশ্য দাবি করেছেন পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে আছে।

তিনি জানান, ‘শহরের জায়গায় জায়গায় সব জমায়েত ভেঙে দেয়া হয়েছে। পুরো এলাকায় বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে, নামানো হয়েছে এক কোম্পানি র‍্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স বা র‍্যাফ-ও।

তবে যেকোনো দাঙ্গার পর যেমনটা হয়, জামশেদপুর এখন গুজবের নগরীতে পরিণত হয়েছে।

পূর্ব সিংভূম জেলার ডেপুটি কমিশনার বিজয়া যাদব গুজবে কান না-দিতে সাধারণ মানুষের কাছে আর্জি জানিয়েছেন। উত্তেজনা ছড়ানোর অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে আটকও করা হয়েছে বলে তিনি জানান।

‘হোয়াটসঅ্যাপে দাঙ্গার প্ল্যান’
ওদিকে গত ৩০ মার্চ রামনবমীর মিছিলের পর পরই বিহার শরিফে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে, সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘর্ষে একজন যুবকের মৃত্যুও হয়।

ওই রাজ্যের সাসারাম ও রোহটাস জেলাতেও রামনবমীকে কেন্দ্র করে ব্যাপক দাঙ্গা-হাঙ্গামা ঘটে।

এরপর আজ বিহার পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিতেন্দ্র সিং গাঙ্গওয়ার সাংবাদিক বৈঠক করে জানান, বজরং দল সোশ্যাল মিডিয়াতে রীতিমতো পরিকল্পনা করে রাজ্যে এই সব সহিংসতা ঘটিয়েছে।

তিনি বলেন, ‘বজরং দলের নালন্দা জেলার প্রধান কুন্দন কুমার রামনবমীর ঠিক আগে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খোলেন, যাতে ৪৫৬ জন সদস্য ছিলেন। উৎসবের সময় কিভাবে দাঙ্গা বাঁধানো হবে, ওই গ্রুপেই সেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কুন্দন কুমার ও তার একজন সহযোগী কিষেণ কুমার ছিলেন এই গ্রুপের অ্যাডমিন।’

পুলিশ তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে শুরু করার পরই এই দু’জন থানায় আত্মসমর্পণ করেছেন বলে গাঙ্গওয়ার জানান। অন্য অভিযুক্তদের খোঁজে এখনো তল্লাসি চলছে।

এর আগে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারও বলেছিলেন, সাসারাম বা বিহার শরিফে আগে কখনো রামনবমীর সময় দাঙ্গাহাঙ্গামা হয়নি। এই ঘটনা ‘মোটেও স্বাভাবিক নয়’।

‘দাঙ্গার এই টাইমিং নতুন’
ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে রামনবমীর সময় এই যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা ঘটতে শুরু করেছে, তার বিশেষত্ব ও প্যাটার্ন নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছেন আমেরিকার ব্রাউন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আশুতোষ ভার্শনে ও গবেষক ভানু জোশী।

ওই প্রতিবেদনে তারা বলেছেন, ভারতে হিন্দুদের দশেরা উৎসব বা শিয়া মুসলিমদের মহরমের সময় দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সঙ্ঘর্ষ বা উত্তেজনা প্রায়ই ঘটে থাকলেও ইদানীং রামনবমী বা হনুমান জয়ন্তীর সময় যে দাঙ্গা হতে দেখা যাচ্ছে, সেটা একটা নতুন ট্রেন্ড।

ভারতের স্বাধীনতার পর প্রথম তিন বা চার দশকে রামনবমী খুবই শান্তিপূর্ণ ও নিভৃত একটি ধর্মীয় উৎসব হিসেবেই পরিচিত ছিল।

এমনকি রামনবমীতে রাস্তায় বড় মিছিল বের করারও বিশেষ রেওয়াজ ছিল না বলে ওই গবেষকরা জানাচ্ছেন।

তিনি আরো বলেন, ‘কিন্তু ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে বিজেপি ও তাদের অনুসারী হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো যখন রামজন্মভূমি আন্দোলন শুরু করেন, তখন থেকেই সেটা পাল্টাতে শুরু করে। জয় শ্রীরাম স্লোগানের মধ্যে দিয়ে ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম রাম’ হিন্দুত্বের নতুন আইকন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।’

রামনবমী হল আসলে হিন্দুদের ভগবান শ্রীরামের জন্মদিনের উৎসব। আর ওই জন্মদিন পালনের জন্য রাস্তায় বড় বড় ধর্মীয় শোভাযাত্রা ও মিছিল বের করা হতে থাকে।

গত কয়েক বছর ধরে সেসব মিছিলে প্রকাশ্যে অস্ত্রশস্ত্র প্রদর্শন করা হচ্ছে বা অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি প্ররোচনামূলক স্লোগান দেয়া হচ্ছে, গান বাজানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠছে, যার জেরে বহু জায়গাতেই সূত্রপাত হচ্ছে অশান্তি ও সহিংসতার।

সূত্র : বিবিসি

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877